আপনাকে এই আর্টিকেলে স্বাগতম। আপনি নিশ্চই জানতে চাচ্ছেন ব্যাবস্থাপনা কি? বা ব্যবস্থাপনা কাকে বলে? অথবা আরো জানতে চাইতে পারেন বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা বলতে কি বুঝায়? ব্যাবস্থাপনার স্তর কী? ব্যবস্থাপনা সর্বজনীন কি? তাহলে চলুন উপরের প্রশ্নগুলিসহ (ব্যবস্থাপনার সংজ্ঞা, ব্যবস্থাপনার পরিধি ও গুরুত্ব নিয়ে নিচে আলোচনা করা যাক।
ব্যবস্থাপনা
ব্যবস্থাপনার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Management’ । ব্যবস্থাপনা বিশারদদের মতে, ‘Management’ শব্দটি ইতালীয় ‘Maneggiare’ শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এর অর্থ ‘To train up the horse.’ অর্থাৎ, অশ্বকে প্রশিক্ষিত করে তোলা। আবার অনেকে মনে করেন, ‘Management’ শব্দটি ফরাসি ‘Menager’ , ‘Menage’ শব্দ দুটো থেকে এসেছে। ‘Menager’ শব্দের অর্থ পরিবার পরিচালনা করা (To direct a household) এবং ‘Menage’ শব্দের অর্থ পথ্ব প্রদর্শন করা (An act of guiding) ।
আধুনিক কালের ব্যবসায় জগতে ব্যবস্থাপনা শব্দটি কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনে পরিচালিত করার অর্থে ব্যবহার করা হয়। তাই, ব্যবস্থাপনার ধারণাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে —
Manage = Men = T (Tactfully) = Management
অর্থাৎ মানুষকে কৌশলে পরিচালনা করা হলো ব্যবস্থাপনা।
ব্যবস্থাপনা কাকে বলে?
প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনে অন্যদের সামর্থ্য ব্যবহার করে কাজ করিয়ে নেওয়ার কৌশল হল ব্যবস্থাপনা । এটি ধারাবাহিক কিছু কাজের (পরিকল্পনা প্রণয়ন, সংগঠিতকরন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা দান, প্রেষণা দান, সমন্বয়সাধন ও নিয়ন্ত্রণ) সমষ্টি। এ কাজগুলো সম্পাদনে মানবীয় মানবসম্পদ ও অমানবীয় উপকরণ (যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, অর্থ) ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে অমানবীয় উপকরণ গুলোর যথাযথ ব্যবহার মানবসম্পদ করে থাকে। তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে মিল থেকে ব্যবস্থাপনার কাজেও নতুন কৌশল নেওয়ার প্রয়োজন হয়।
অতএব, প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন, সংগঠিতকরন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয়সাধন ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উপকরণ ও সম্পদসমূহকে সুষ্ঠভাবে কাজে লাগানোর প্রক্রিয়াকে ব্যবস্থাপনা বলে।
বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা বলতে কি বুঝায় বা বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা কাকে বলে?
বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পরিচালিত ব্যবস্থাপনায় মূলত বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা। এফ ডব্লিউ টেলর সাধারণ শিক্ষানবিশ থেকে প্রধান প্রকৌশলী পর্যন্ত বিভিন্ন পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তার কাছে শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সমস্যা ধরা পড়ে। তিনি সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের উপায় নিয়ে দুই দশক গবেষণা চালান। এভাবে তিনি তার গবেষণা কাজের ফলাফলকে একটা দর্শনের রূপ দেন। এটি বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনা নামে পরিচিত।
ব্যবস্থাপনার স্তর কী?
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ব্যবস্থাপকীয় পদ ও কার্যাবলীকে যখন উপর থেকে নিচের দিকে সাজানো হয়। তখন তাকে ব্যবস্থাপনার স্তর বলে।
ব্যবস্থাপক কে?
যে ব্যাক্তি বা কর্মী আনুষ্ঠানিকভাবে দলবদ্ধ হয়ে কোনো কাজ করিয়ে নেন তাকে ব্যবস্থাপক বলে।
ব্যবস্থাপনা সর্বজনীন – কাকে বলে?
ব্যবস্থাপনার সর্বজনীনতা বলতে সর্বত্র সব ক্ষেত্রে সকলের দ্বারা স্বীকৃত ব্যবস্থাপনা জ্ঞানের আবশ্যকতা ও প্রয়োগ যোগ্যতাকে বোঝায়। পরিবার রাষ্ট্র এবং ব্যবসায় সংগঠনের সব ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার কার্যাবলী (পরিকল্পনা প্রণয়ন সংঘটিতকরণ নির্দেশনা প্রেষনা ও নিয়ন্ত্রণ) প্রয়োগ করা হয়। স্থানীয় পরিবেশ পরিস্থিতি সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বিভিন্ন হতে পারে। তবে ব্যবস্থাপনার কার্যাবলী প্রয়োগের ক্ষেত্রে তেমন কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না তাই ব্যবস্থাপনা কে সর্বজনীন বলা হয়
ব্যবস্থাপনার সংজ্ঞা
নিচে ব্যবস্থাপনার কয়েকটি সংঙ্গা উল্লেখ করা হলো —
- আধুনিক ব্যবস্থাপনার জনক হেনরি ফেয়ল (Henri Fayol) এর মতে: To manage is to forecast and plan, to organize, to command, to coordinate and to control. অর্থাৎ, ব্যাবস্থাপনা হলো পূর্বানুমান ও পরিকল্পনা, সংগঠিতকরণ, নির্দেশ দান, সমন্বয়সাধন এবং নিয়ন্ত্রন।
- যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়-এর অধ্যাপক হ্যারল্ড কুঞ্জ (Harold Koontz) এর মত : ‘Management is an art of getting things done through and with the people in formally organized groups’. অর্থাৎ, কর্মীদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলবদ্ধ করে কোনো কাজ করিয়ে নেওয়ার কৌশলকে ব্যবস্থাপনা বলে।
- যুক্তরাষ্ট্রের বল স্টোট বিশ্ববিদ্যালয় – এর অধ্যাপক জর্জ রবার্ট টেরি এবং স্টিফেন জি. ফ্রাঙ্কলিন (George Robert Terry and Stephen G. Franklin) এর মতে, ‘Management is a distinct process consisting of activities objectives with the use of human beings and other resources. অর্থাৎ, ব্যবস্থাপনা হচ্ছে এমন একটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া; যা মানুষ ও অন্যান্য সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন, সংগঠিতকরণ, উদ্ধুদ্ধকরণ ও নিয়ন্ত্রন কাজের সাথে সম্পৃক্ত।
- যক্তরাষ্ট্রেন টেক্রাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয় – এর অধ্যাপক রিকি ডব্লিউ, গ্রিফিন (Rick W. Griffin) এর মতে : ‘Management is a set of activities (including planning and decision making, organizing, leading and controlling) directed at an organization’s resources (human, financial, physical and information) Towards achieving organizational objectives efficiently and effectively. অর্থাৎ, ব্যবস্থাপনা বলতে একগুচ্ছ কার্যাবলিকে (পরিকল্পনা প্রণয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহন, সংগঠিতকরণ, নেতৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রন) বোঝায়; যা সংগঠনের লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে সংগঠনের সম্পদসমূহ (মানবীয়, আর্থিক, প্রাকৃতিক এবং তথ্য দক্ষতার সাথে কার্যকরভাবে পরিচালনা করে ।
ব্যবস্থাপনার পরিধি
১/ সংগঠনের ভিত্তিতে ব্যবস্তাপনার পরিধি-
ক. পারিবরিক জীবনে : প্রতিটি পরিবারকে একটি সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা যায়। মানুষের পারিবারিক জীবনের সব ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার প্রয়োগ আছে। পরিবারের দৈনন্দিন কাজ করতেও আমাদেরকে পরিকল্পনা প্রণয়ন সংগঠন করতে হয়, নির্দেশনা দিতে হয় এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা মানুষের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনকে সফল ও সুন্দর করে তোলে।
খ. ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে : ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন নির্ভর করে কার্যকর ব্যবস্থাপনার উপর। ব্যবস্থাপনার রীতিনীতি কলা কৌশলের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হয়। তাই ব্যবসায়ের সব ধরন ও ক্ষেত্রে (ব্যাংক, বিমা, হোটেল, হাসপাতাল প্রভৃতি) ব্যবস্থাপনা বিস্তারিত।
গ. সামাজিক ও ধর্মীয় সংঠনে : সমাজের কল্যাণে আমরা যেসব কাজ করি তা ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কিত। সামাজিক ধর্মীয় সংগঠনগুলোর মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মসজিদ ক্লাব সমিতি কল্যাণমূলক সংস্থা অন্যতম। এসব প্রতিষ্ঠান সফলভাবে পরিচালনা করার জন্য ব্যবস্থাপনার রীতিনীতি ও কলা কৌশল প্রয়োগ করা আবশ্যক।
ঘ. রাজনৈতিক ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক দলকে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমানে প্রায় সব দেশে একাধিক রাজনৈতিক সংগঠন আছে। জনসমর্থন পাওয়ার জন্য এদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা দেখা যায়। সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা ছাড়া কোন দলই তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না। তাই বলা যায় ব্যবস্থাপনার পরিধি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বিরাজমান।
ঙ. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে : রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আছে যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন,বাংলাদেশের রেলওয়ে। ব্যবস্থাপনার সঠিক প্রয়োগ ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠান সফলভাবে পরিচালনা করা যায় না। তাই সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সফল ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
চ. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে : বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ধরনের সংগঠন আছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন, ADB, IMF, WHO, FAO, IDB, UNCEF, UNDP বিশ্বব্যাপী কাজ করছে। এগুলোর পরিচালনার জন্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখছে।
ব্যবস্তাপনার গুরুত্ব :
ক. সহজে লক্ষ্য অর্জন : প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাঙ্ক্ষিত ফলকে লক্ষ্য বলা হয়। এই লক্ষ অর্জনের পথে ছোট ছোট ধাপ বা মাইলফলককে উদ্দেশ্য বলা হয়। ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সহজে পরিকল্পনা তৈরি সংগঠিত করণ কর্মসংস্থান নির্দেশনা প্রেষণা সাধন ও নিয়ন্ত্রণের কাজ করা যায়। তাই একে লক্ষ্য উদ্দেশ্য অর্জনের একটি কার্যকর কৌশল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
খ. উপকরণাদির সুষ্ঠ ব্যবহার : কোন কাজ করতে যেসব উপাদান ব্যবস্থা ব্যবহৃত হয় সেগুলোকে উপকরণ বলা হয়। উৎপাদনের প্রধান উপকরণ গুলো হলো ভূমি শ্রম মূলধন ও সংগঠন। এসবের সঠিক ব্যবহার ব্যবস্থাপনার সর্বজনীন উদ্দেশ্য। কোন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় ভুমি শ্রম মূলধন থাকার পরও দক্ষ ব্যবস্থাপনা না থাকলে এগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে।
গ. উত্তম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা : একটি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পক্ষ থেকে যেমন মালিক ব্যবস্থাপক শ্রমিক কর্মী ক্রেতা ভোক্তা ও সরবরাহকারী। এসব পথের মধ্যে কোন মতবিরোধ হলে তা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কমিয়ে আনা যায়। ব্যবস্থাপনার কাজ সম্পাদনে বিভিন্ন ব্যক্তি বা পক্ষের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করতে হয়। ফলে তাদের সাথে উত্তম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায়।
ঘ. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি : কাজ করা নতুন ক্ষেত্রকে কর্মসংস্থান বলা হয়। কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ করা যায়। এছাড়া নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয় যা দেশের বেকার সমস্যা কমাতে ভূমিকা রাখে।
ঙ. গবেষনা ও উন্নয়ন : নতুন কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বা কোন বিষয়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য পদ্ধতিগত অনুসন্ধানকে গবেষণা বলা হয়। প্রতিযোগিতা মোকাবিলা ক্রেতা বক্তাদের পরিবর্তনশীল চাহিদা পূরণ ও নতুন পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রতিনিয়ত গবেষণা ও উন্নয়নের প্রয়োজন হয়। কার্যকর ব্যবস্থাপনা এসব কাজে সহায়তা করে থাকে।
আশা করি আপনি জানতে পেরেছেন ব্যবস্থাপনা কাকে বলে? এর গুরুত্ব ও পরিধি সম্পর্কে। ব্যবস্থাপনা কাকে বলে এটি সম্পর্কে আরো জানতে কমেন্টে জানাবেন। এবং ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও পরিধি সম্পর্কে কম লেখা হয়েছে আপনি যদি এ বিষয়ে আরো জানতে চান তাও জানাবেন।
—আপনি চাইলে শিক্ষা রিলেটেড সমস্ত পোস্টগুলি দেখতে পারেন —